খুলনা, বাংলাদেশ | ২২শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ | ৬ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

Breaking News

  খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত পাঁচ বছরের শিশুর মৃত্যু
  চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলায় দুর্বৃত্তের গুলিতে যুবদল নেতা নিহত

একজন মানবিক ডাক্তারের সান্নিধ্যে

কামরুল ইসলাম

আমার ন্যাংটাকালের বন্ধু অসুস্থ। জরুরি অপারেশন করতেই হবে। তার স্ত্রী খুলনার ডাক্তারের কাছে ধর্ণা দিতে দিতে অতিষ্ঠ হয়ে আমাকে ফোন করেছিল কয়েকবার। আমি গ্রামে একটি স্কুলের ভবন নির্মাণে ভীষণ বিজি। তবুও দুইদিন আগে মানবিক ডাক্তার জনাব এটিএম মঞ্জুর মোরশেদ ভাইকে ফোন করলে তিনি বললেন- আমাকে যদি আস্থা করেন তাহলে আমার হাসপাতালে আনতে পারেন।

মানবিক ডাক্তার জনাব এটিএম মঞ্জুর মোরশেদ ফুলতলা উপজেলা সদরে ‘এ গফুর মেমোরিয়াল হাসপাতাল’ করেছেন। তাঁর বাবার নামে সেবামূলক এই প্রতিষ্ঠানটি গুণে মানে চমৎকার। এর আগে তিনি খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ছিলেন। আমি ছিলাম খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিসি ডিবি। ঐ সময় খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল দালাল মুক্ত করতে এবং রোগীর সর্বোচ্চ সেবা প্রদানের লক্ষ্যে আমরা দু’জন আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলাম। ‘সোনামুখ মেডিকেল সেবা’ নাম দিয়ে ১০০ সদস্যের একটি স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন করে আমরা একযোগে কাজ করেছিলাম। তৎকালীন পুলিশ কমিশনার জনাব খন্দকার লুৎফুল কবির সাহেবের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এই সেবামূলক কাজে অনেক সাফল্য  পেয়েছিলাম।

শ‌নিবার সকাল দশটায় খুলনার বাসা থেকে  আমার বন্ধুকে নিয়ে তার স্ত্রী হাসপাতালে রওায়ানা দিয়ে আমাকে ফোন করলে আমিও আমার সকল কাজ ফেলে হাসপাতালে রওয়ানা করলাম। রাস্তায় যানবাহনের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। এমন সময় আমার প্রতিবেশী কাসিব মোটরসাইকেল নিয়ে যাবার সময় তাকে ধরে নিয়ে ফুলতলার দিকে রওয়ানা হলাম। প্রায় দশ কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিয়ে হাসপাতালে পৌঁছে ডাক্তার সাহেবের সাথে দেখা করে কুশল বিনিময় করলাম। রোগীর অধিকাংশ পরীক্ষা নিরীক্ষা আগেই করা হয়েছিল। দু’একটা পরীক্ষা বাকী ছিল।  তা তাৎক্ষণিকভাবে করা হলো। ডাক্তার সাহেব বললেন- আজকেই অপারেশন করা যাবে। কিন্তু রোগী ও তার স্ত্রী মারাত্মক ভয় পেয়ে গেল। তারা কোনমতে আজকে অপারেশন করতে রাজি হলো না। এদিকে আমারো সময় কম। এই কাজে আরো একদিন সময় দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই এক প্রকার জোর করে তাদের রাজি করালাম। ইতোমধ্যে নওয়াপাড়া থেকে আমাদের আর এক বন্ধু অধ্যাপক হাফিজুর রহমান হাজির হলো। ঘন্টা খানেকের মধ্যে অপারেশন শেষ করে রুগীকে কেবিনে আনা হলো।

এরমধ্যে দুপুরে খাবারের সময় হয়ে গেল। ডাক্তার সাহেব বললেন- বাসায় চলেন। আপনার ভাবি খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছে। আমরা ‘না’ বলার আগেই তিনি এক প্রকার টেনেই বাসায় নিয়ে গেলেন। খাবার টেবিলে গিয়ে দেখি, সে এক এলাহী কান্ড। ভাবী ও তাঁর ডাক্তার পুত্রবধু বিশেষ যত্ন সহকারে নানা পদের খাবার দিলেন। আমরা তৃপ্তি সহকারে খেলাম।

এরপর হাসপাতালের বিল, ঔষধের দাম, কেবিন ভাড়া, অপারেশন খরচের কথা বলতেই ডাক্তার সাহেব বললেন- কামরুল ভাই, আপনার টাকা আমার টাকা একই কথা। অতএব আজকের বিলটা নাহয় আমি দিলাম।

তাঁর কথা শুনে আনন্দ অশ্রুতে আমার চোখ দুটো ভিজে গেল। আমার সাথে থাকা অধ্যাপক হাফিজুর রহমানও অবাক বনে গেল।

ডাক্তার সাহেব আরো বললেন- আল্লাহর রহমতে আমি পৃথিবীর সেরা সুখী মানুষের একজন। তাঁর মেয়ে ডাক্তার, জামাই ডাক্তার,  ছেলে ডাক্তার, পুত্রবধু ডাক্তার। স্ত্রী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স (আমরা দুজনেই একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একই সাবজেক্টে পড়েছি) । তাঁর স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, নাতি, নাতনি নিয়ে তিনি মহা সুখে আছেন।

তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে শেষ করতে পারবো না বলে, আমি ও অধ্যাপক হাফিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। হাফিজ চলে গেল নওয়াপাড়ায়। আমি আসবো আমার বাড়ি। নিচে নেমে দেখি, হাসপাতালের ম্যানেজার সাহেব মোটর সাইকেল নিয়ে আমাকে বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমি তাকে কষ্ট দিবো না বলে, তার সাথে যেতে আপত্তি করলাম। তিনি বললেন- আমি আপনাক চিনি।  আপনার মতো মানুষের সাথে কিছু সময় থাকতে পারলে আমি ধন্য হবো। দয়া করে আমাকে বঞ্চিত করবেন না।

এতবড় কথা অমান্য করা কোন মানুষের পক্ষে কি সম্ভব?
উঠে পড়লাম তার মোটরসাইকেলে। কিন্তু একটুখানি যেতেই শুরু হলো বৃষ্টি। তাই ঢুকে পড়লাম একটা চায়ের দোকানে। প্রায় ঘন্টা খানেক বসে থাকায় একজন বয়স্ক মানুষ এসে বললেন- আপনাকে চেনা চেনা লাগছে। আমি কি আপনাকে একটু চা খাওয়াতে পারি?
আমি বললাম- একটু আগে চা খেয়েছি। এখন আর খাবো না। আপনাকে ধন্যবাদ।
তিনি পুনরায় বললেন- আপনি কি খুলনার পুলিশে চাকরি করতেন?
– জী, ভাই।
– তাহলে আপনাকে চা খেতেই হবে। কারণ আপনার অনেক ভাল কাজের কথা আমি জানি।

তাঁর কথা শুনতে
আমার ভালো লাগছিল। একটু লজ্জাও লাগছিলো।

হঠাৎ বৃষ্টি কমে গেলে সেই ভদ্রলোক আমার মাথায় একটি পলিথিনের ব্যাগ পেচিয়ে দিয়ে বিদায় দিলেন।

সামান্য বৃষ্টিতে মোটরসাইকেলে তেমন অসুবিধা হচ্ছিল না। কিন্তু ধোপাখোলা গ্রামে এসে বৃষ্টি বেড়ে গেল। তখন রাস্তার পাশে একটি ঔষধের দোকানে ঢুকে পড়লাম। আমাকে দেখে ঐ দোকানের মালিক নিজের চেয়ার ছেড়ে আমাকে জোর করে সেখানে বসাতে চাইলেন। আমি তার প্রস্তাবে রাজি না হয়ে পাশের টুলে বসে পড়লাম। আমি এই দোকানের মালিককে চিনি না। হয়তো তিনি আমাকে চিনতেন। তাই তিনি অন্যান্যদের কাছে গর্ব করে বললেন- ইনাকে চেনেন? ইনি হলেন কামরুল দারোগা। আমার সৌভাগ্য যে তিনি আমার দোকানে এসেছেন।
তারপর আমাকে নিয়ে নানান গল্প শুরু করলেন। সাথে বাদাম ও চায়ের অর্ডার দিলেন। প্রায় আধাঘণ্টা পর বৃষ্টি কমে গেলে আবার রওয়ানা হলাম সেই মোটরসাইকেলে।

নাছোড়বান্দা ম্যানেজার সাহেব আমাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে যাওয়ার সময় বলে গেলেন- দীর্ঘদিন ধরে আপনার নাম শুনতাম। আজকে সৌভাগ্যক্রমে আপনার সান্নিধ্যে ভীষণ খুশি হলাম।

আমি এখন ভাবছি- আমিও তো অনেক পেলাম। আমার জীবনে আর কি চাই।

মানবিক ডাক্তার জনাব এটিএম মঞ্জুর মোরশেদ ভাই ও তাঁর পরিবার, তাঁর ম্যানেজার টিপু সাহেব, রাস্তায় যাদের সাথে বৃষ্টিবিঘ্নতার জন্য পরিচয় হলো তাদের সকলের কাছে আমি ঋণী হয়ে গেলাম।

 

খুলনা গেজেট/এনএম




খুলনা গেজেটের app পেতে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, অডিও, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।

© 2020 khulnagazette all rights reserved

Developed By: Khulna IT, 01711903692

Don`t copy text!